সজিনা চাষ পদ্ধতি ও গুনাগুন !!!

1
6166
সজিনা চাষ পদ্ধতি ও গুনাগুন

সজিনা পুষ্টি ও বিভিন্ন খাদ্যগুণসমৃদ্ধ সবজি। সজিনা গাছকে প্রচলিত বিভিন্ন খাদ্য প্রজাতির মধ্যে সর্বোচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন উদ্ভিদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বহুবিধ খাদ্যগুণসম্পন্ন হওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকায় সজিনা গাছকে ‘জাদুর গাছ’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।

সাধারণ নাম ‘সাজনা’ আর শুদ্ধ ভাষায় সজিনা। এর বৈজ্ঞানিক নাম মোরিনগা অলিফেরা (Moringa Oleifera Lam)। এর বহু রকম গুণের জন্য আমার অনেক সম্বলকৃত নাম আছে। যেমনঃ শোভাঞ্জন, সুপত্রক, উপদংশ, তীক্ষ্মগন্ধ, সুখামোদ,দংশমূল, শিগ্রু, রুচিরঞ্জক, মধুশিঘ্রক। সজিনা মোরিনগেসি (Moringaceae) গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। সজিনা আমাদের দেশে একটি বহুল পরিচিত গাছ। এর কাঁচা লম্বা ফল সবজি হিসেবে খাওয়া হয়।

ইংরেজরা এতো বেরসিক যে তারা আমার নাম দিয়েছে-Horse radish ও Drumstick. কিন্তু ভেষজ পন্ডিতরা সেই পুরাকাল থেকে যেমন-চরক, শ্রুত, বাগভাঁটা, বঙ্গসেন, চক্রদত্ত সবাই আমার নানা রকমের গুনের উল্লেখ করেছেন। আমার মূল, ছাল, ফল, ফুল, বীজ সবার মধ্যেই আছে ঔষধি গুণ।

সাধারণত এ গাছের উচ্চতা ২৩ ফুট থেকে ৩৩ ফুট বা তারও বেশি হয়ে থাকে। সজিনা গাছের কাঠ অত্যন্ত নরম, বাকলা আঠাযুক্ত ও কর্কি। সজিনা তিন ধরনের নীল, শ্বেত ও রক্ত সজিনা। ড্রামস্টিক, মরিঙ্গাসহ দেশ-বিদেশে সজিনার বিভিন্ন নাম রয়েছে।

ইংরেজীতে সজিনার নাম ‘‘ড্রামস্ট্রিক’’ যার অর্থ ঢোলের লাঠি। সজিনার ইংরেজী নামটি অদ্ভুত হলেও এটি একটি অতি প্রয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী উদ্ভিদ। বাংলাদেশে এটি নিয়ে তেমন গবেষণা না হলেও বিশ্বের বহু দেশে এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে বিশেষ করে গাছ বৃদ্ধিকারক হরমোন, ঔষধ, কাগজ তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে। বহু দিন হতেই আমাদের দেশে এটি সবজির পাশাপাশি ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে।

দেশের সবত্রই এ সবজিকে আমরা দেখতে পাই। বিশেষ করে গ্রামের রাস্তার ধারে এবং বসত বাড়ির আঙ্গিনায় যত্ন ছাড়াই বেড়ে ওঠে এ বৃক্ষটি। সজিনার ফুল ও পাতা শুধু শাক হিসেবেই নয়, পশু খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার হয়ে থাকে। এর পাতা শাক হিসেবে ব্যবহার করা যায় এতে শারীরিক শক্তি ও আহারের রুচির উন্নতি হয়। এর মধ্যে আছে ভিটামিন এ, বি, সি, নিকোটিনিক এসিড, প্রোটিন ও চর্বি জাতীয় পদার্থ, কার্বোহাইড্রেট ইত্যাদি। ভারতীয়রা এটির স্যুপ খেয়ে থাকে। এ সময়ে ঋতু পরিবর্তনের কারণে আমাদের অনেকেরই মুখে স্বাদ থাকে না। আর এ স্বাদকে ফিরিয়ে আনতে সজিনার জুড়ি নাই।  সজিনার গাছটির প্রতি আমাদের তেমন আগ্রহ না থাকলেও এর ডাটার প্রতি আগ্রহ নেই এমন মানুষ খুজে পাওয়া কঠিন। আমরা জানি সবজি মাত্রই পুষ্টিকর খাদ্য। তবে সজিনা শুধু পুষ্টিকর সবজি নয় এটি ওষুধি বৃক্ষও বটে।

সজিনা চাষ

সজিনার বহুমুখী ব্যবহার:

  • ফুলঃ সজিনার ফুল বসন্তকালে খাওয়া ভাল কারণ এটি বসন্ত প্রতিষেধক। এটি সর্দি কাশিতে, যকৃতের কার্যকারীতায়, কৃমি প্রতিরোধে, শক্তি বৃদ্ধিতে কার্যকারীতা রয়েছে।
  • ডাটাঃ এর ডাটা বা ফলে প্রচুর এমাইনো এসিড আছে। এটি বাতের রুগীদের জন্য ভাল।
  • বীজঃ এর বীজ থেকে তেলও পাওয়া যায় যা বাতের ওষুধ তৈরির কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে এবং ঘড়ি ঠিক করার জন্য যে বেল ওয়েল (Ben oil) ব্যবহার হয় তা এর বীজ হতে পাওয়া যায়।
  • ছাল: সজিনার ছাল থেকে তৈরি হয় দড়ি।

জলবায়ু:

সজিনা চরম পরিবেশ গত অবস্থা সহ্য করতে সক্ষম তবে ২০ হতে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভাল জন্মায় এবং যেসব এলাকায় ২৫০ হতে ১৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় সেখানে ভাল জন্মায়। মাটি বেলে দোঁআশ হতে দোয়াঁশ এবং পিএইচ ৫.০ হতে ৯.০ সম্পন্ন মাটি সহ্য করতে পারে। সজিনা চাষে সারের তেমন প্রয়োজন হয়না। কারণ সজিনার বিস্তৃত ও গভীর শিকড় রয়েছে। তবে ইউরিয়া এবং জৈব সার প্রয়োগ করলে গাছ ভাল হয়।

বংশ বিস্তার:

এ বৃক্ষটি বীজ ও ডাল এর মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা সম্ভব। তবে আমাদের দেশে বীজ থেকে চারা তৈরি করে চাষাবাদের রীতি এখনও পর্যন্ত অনুসরন করা হয়না। কারণ বীজ থেকে চারা তৈরি ব্যয়বহুল, কষ্ঠসাধ্য এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রে এপ্রিল-মে মাসে গাছ থেকে পাকা ফল সংগ্রহ করতে হবে, তারপর সেটিকে শুকিয়ে ফাটলে বীজ পাওয়া যাবে। এ বীজ শুকনো বায়ুরোধী পাত্রে ১-৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখতে পারি। তারপর জুলাই-আগষ্ট মাসে বীজ তলায় অথবা পলি ব্যাগে বপন করতে পারি। তবে বীজ বপনের আগে বীজগুলোকে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। এতে বীজ থেকে চারা গজাতে সুবিধা হয়। বীজ থেকে চারা বের হতে সময় লাগে ১০ থেকে ২০ দিন। চারা বের হবার পর নিয়মিত সেচ, সার প্রয়োগ ও অন্যান্য যত্ন পরিচর্যা করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল যে, বীজ থেকে সজিনা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ডাল পুঁতে অঙ্গজ বংশ বিস্তারের চেয়ে দেরিতে ফল আসে।

আমাদের দেশে ডাল পুঁতে অঙ্গজ উপায়ে বংশ বিস্তার পদ্ধতিটি বেশি ব্যবহৃত হয়। তার কারণ হল এটি করতে তেমন দক্ষতার প্রয়োজন হয়না।  আর খরচও কম, অঙ্গজ বংশ বিস্তারের জন্য  ৪-৫// ব্যাসের  বা বেডের ৫-৬ হাত লম্বা নিরোগ ডাল এবং আঘাত মুক্ত ডাল ব্যবহার করা ভাল।  এটিতে যখন পাতা আসে তখন ছাগল এটিকে খেয়ে নষ্ট করে ফেলে। ডালটি লাগানোর সময় যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে সেটি হল ডালটি গাছে থাকা অবস্থায় এর আগা বা মাথা এবং গোড়া যে  দিকে ছিল পুঁতার সময় যেন ঠিক সেই ভাবেই থাকে।  লাগানোর আগে ডালের গোড়ায়  একটি ধারালো কিছু দিয়ে তেড়ছা কাট দিতে হবে  তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন থেঁতলে না যায়।  এ কাজটি করলে ডালটি টিকে যাবার সম্ভাবনা অনেকগুন বেড়ে যায়। ডালটির গোড়ার প্রায় এক হাত যেন মাটির নিচে থাকে এবং পুঁতার পর যেন এটি নাড়াচড়া না করে  সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ডাল এর মাধ্যমে বংশ বিস্তারের কাজটি আমাদের  দেশে করা হয়ে থাকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত। কারণ এ  সময় ডাটা সংগ্রহের পর গাছগুলোকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়। ফলে অঙ্গজ বংশ বিস্তারের জন্য এর সহজ প্রাপ্যতা বেড়ে যায়।  তাছাড়াও এ সময়ে অল্পকিছু বৃষ্টি হয়ে থাকে যার ফলে লাগানো ডালটি সহজেই টিকে যায়।

সজিনা

সেচ:

নতুন লাগানো গাছে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে শীঘ্রই শিকড় গজাতে পারে। শুস্ক ও রৌদ্রজ্জ্বল সময় প্রায় দুই মাস সেচ দিতে হবে। তবে সজিনার গাছ একবার লেগে গেলে তেমন পানির প্রয়োজন হয়না।

কীটপতঙ্গ ও রোগ নিয়ন্ত্রন:

সজিনার গাছ তুলনামূলক কীটপতঙ্গ ও রোগ সহনশীলভাবে বেড়ে ওঠে। তবে মাঝে মাঝে রোগের প্রার্দুভাব দেখা যায়। যেমন জলাবদ্ধ মাটিতে শিকড় পচা রোগ দেখা দিতে পারে এর কারণ ডিপ্লোডিয়া। কীট পতঙ্গ শুস্ক ও ঠান্ডায় বেশি আক্রমন করে। কীট পতঙ্গ দ্বারা গাছে  হলুদ রোগ দেখা যায়। কীটপতঙ্গের মধ্যে টারমাইটস্, এফিড, সাদা মাছি প্রধান। উপদ্রুপ বেশি হলে রাসায়নিক দমন ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

তাছাড়া সজনাতে প্রতি ১০০ গ্রামে খাদ্যপোযোগী পুষ্টি উপাদান হচ্ছে –

  • জ্বলীয় অংশ         =         ৮৩.৩ গ্রাম
  • খনিজ                =         ১.৯ গ্রাম
  • আঁশ                  =         ৪.৮ গ্রাম
  • খাদ্যশক্তি            =         ৬০ কিলোক্যালোরি
  • প্রোটিন               =         ৩.২ গ্রাম
  • চর্বি                   =         ০.১ গ্রাম
  • শর্করা                =         ১১.৪ গ্রাম
  • ক্যলশিয়াম          =         ২১.০ মিলিগ্রাম
  • লোহা                 =         ৫.৩ মিলিগ্রাম
  • ক্যারোটিন          =         ৭৫০ মাইক্রোগ্রাম
  • ভিটামিন=বি=১   =         ০.০৪ মিলিগ্রাম
  • ভিটামিন=বি=১   =         ০.০২ মিলিগ্রাম
  • ভিটামিন=সি       =         ৪৫.০ মিলিগ্রাম

ইতি কথা:

স্বাদে ও গুনে ভরপুর এ সবজিটির প্রতি আমদের সকলের আগ্রহ থাকলেও এর চাষাবাদের প্রতি আমদের অনাগ্রহের কথা অস্বীকার করা যায়না। তাই অন্যান্য সবজির মত এটি আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। তাই এটি  এখন বিলুপ্তির পথে। এ অবস্থায় চট্টগ্রামের রাইখালী কৃষি গবেষণা কেন্দ্র গবেষণা চালিয়ে এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি বারোমাসি জাত উদ্ভাবনে সফল হয়েছে।তবে আমাদের দেশে গ্রামের বাড়িগুলোতে এটি ব্যাপকভাবে চাষ হয়ে থাকে এবং সজিনা বিহীন বাড়ি না পাওয়ারই কথা। তবে এ সবজি চাষে যদি আমরা একটু মনোযোগী হই অর্থাৎ এর  বানিজ্যিক উৎপাদন সন্বদ্ধে চিন্তা করি তবে অন্যান্য যেকোনো সবজি উৎপাদনের থেকে এটি লাভজনক। কারণ অন্যান্য সবজির মত এর উৎপাদনে তেমন ঝুঁকি নেই এবং লাভজনক।

Comments are closed.