এবার খাঁচায় হবে মাছ চাষ!!! মৎস্য উৎপাদনে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন

0
2678
মাছ চাষ

“নদীর ওপর ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ” ঠিক অবাক হওয়ার মত বিষয় হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে আজ নদীর ওপর ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ হচ্ছে। বিশ্ব অ্যাকুয়াকালচারে খাঁচায় মাছ চাষের ইতিহাস অনেক পুরোনো। খাঁচায় মাছ চাষ শুরু হয় চীনের ইয়াংঝি নদীতে আনুমানিক ৭৫০ বছর আগে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার কারণে আধুনিক কালে খাঁচায় মাছ চাষ ক্রমাগতভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিভিন্ন ধরনের জলাশয়ে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ উপযোগী আকারের খাঁচা স্থাপন করে অধিক ঘনত্বে বাণিজ্যিক ভাবে মাছ উৎপাদনের প্রযুক্তি হলো খাঁচায় মাছ চাষ। ব্যবস্থাটি অত্যন্ত ত্বরিৎ গতিতে প্রসারিত হচ্ছে, কত মানুষ আজ এ পেশায় নিজের কর্ম সংস্থান করছেন,  আবার অনেকে উদ্দ্যোক্তা হিসেবে এই পেশায় আত্মনিয়োগ করছেন। এ পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় আমিষের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতির উন্যয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।

খাঁচায় মাছ চাষে কী কী সুবিধা পাবেন:

দেশের প্রধান নদীসমূহ- ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, হালদা, সুরমাসহ অধিকাংশ নদ-নদীর বাঁকে এ ধরনের মৎস্য চাষ সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে পানি দূষণমুক্ত, খরস্রোতমুক্ত এবং শত্রুমুক্ত হওয়া প্রয়োজন।

  • নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ করলে সহজেই প্রবহমান নদীর পানি পাওয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক উৎস্য থেকেও অনেকটা খাবার পাওয়া যায়।
  • পুকুর খনন ও তৈরির অতিরিক্ত খরচ কমে যায়।
  • যেকোনো সময়ই খাঁচার সংখ্যা বৃদ্ধি করে খামার সম্প্রসারণ সম্ভব।
  • নদীর প্রবহমান পানিতে প্রচুর অক্সিজেন থাকায় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
  • খাঁচার মাছের বর্জ্য পানির স্রোতে অন্যত্র চলে যায়, ফলে পানি দূষিত হয় না।

যদিও খাঁচা তৈরিতে কিছু খরচ হয়, তথাপি ভূমির মালিকানা সমস্যা, ভূমি ক্রয় এবং ভূমির ব্যবহার থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

এবার খাঁচায় হবে মাছ চাষ
চিত্র : নদীর ওপর ভাসমান মাছ চাষে খাঁচা তৈরীর আদর্শ উপায়

খাঁচা তৈরি এবং সম্ভাব্য খরচ:

২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি খাঁচা তৈরিতে খরচ হয় প্রায় ১৬ হাজার টাকা, যা চার-পাঁচ বছর স্থায়ী হয়। প্রথমেই জিআই পাইপ দ্বারা সাধারণত (দৈর্ঘ্য ২০ ফুট × প্রস্থ ১০ ফুট × উচ্চতা ৬ ফুট) বা (দৈর্ঘ্য ১২ ফুট × প্রস্থ ১০ ফুট × উচ্চতা ৬ ফুট) সাইজের আয়তকারের ফ্রেম তৈরি করতে হবে। ওই ফ্রেমের প্রতিটি কোণে ১০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট একটি করে জিআই পাইপ ঝালাই করে বসিয়ে দিতে হবে। এরপর ফ্রেমের চারপাশে জাল বেঁধে দিতে হবে। প্রতি দুই ফ্রেমের মধ্যে তিনটি করে প্লাস্টিকের ড্রাম স্থাপন করে পানিতে সারিবদ্ধভাবে ফ্রেমগুলো স্থাপন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক নোঙর দিয়ে খাঁচাটি পানির নির্দিষ্ট স্থানে বসাতে হবে। এ ক্ষেত্রে জিআই পাইপের স্থলে বাঁশও ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে স্থায়িত্বকাল কম হয়।

তিন বা চার ইঞ্চি থেকে এক ইঞ্চি ফাঁস আকারের মূল পলিথিলিন জাল বা এইচডিপি জাল, খাদ্য আটকানোর বেড় তৈরির জন্য পলিয়েস্টার কাপড়, নাইলনের দড়ি, এক ইঞ্চি জিআই পাইপ, ভাসমান খাঁচার জন্য পিভিসি ব্যারেল বা ড্রাম, খাঁচা স্থির রাখার জন্য বাঁশ। এই জালের খাঁচা এক বিশেষ ধরনের পলিথিন জাতীয় সুতা থেকে তৈরি। এই জাল সাধাণত গিরাবিহীন মেশিনে তৈরি করা হয়। আবার আপনি চাইলে গিড়া দিয়ে হাতেও তৈরি করে নিতে পারেন। বর্তমানে বিদেশ থেকে আমদানি করা ঐ জাল বাজারেও পাওয়া যায়। এই পলিথিন সুতার জালের সুবিধা হল, এই জাল কাঁকরায় কাটতে পারে না, পানিতে পচে না। বছরে দুটি ফসল তোলা কোনো সমস্যা নয়। বর্ষা মৌসুমে বিলে আবার শীত মৌসুমে খালে।

কী মাছ চাষ, কী মাপের পোনা এবং কী পরিমাণ পোনা ছাড়বেন:

খাঁচায় কিন্তু সব ধরনের মাছের চাষ করা যায় না বা ভালো উৎপাদন পাওয়া যায় না। কী মাছ চাষ করবেন সেটা সফলতার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন:

১. বিদেশী ঘাওর
২. নাইলোটিকা
৩. রাজপুঁটি
৪. কার্প প্রজাতি
৫. পাঙ্গাশ।
এই সমস্ত মাছের গড় উৎপাদন ৪/৫ মাসে প্রতি ঘনমিটারে ৫/১৫ কেজি। আবার পোনা ক্ষেত্রে সব সময়ই বড় সাইজের ছাড়া ভালো। এতে সুবিধা হল চাষকালীন সময় কম লাগবে। পোনা যত বড় সাইজের পাওয়া যায় তত আপনার জন্য লাভজনক। তবে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি এর কম হলে চলবে না। কারণ জালের ওপর নির্ভর করে পোনা ছাড়তে হবে। প্রতি ঘন মিটারে আপনি কি পরিমাণ পোনা ছারবেন সেটার কোনো সুনিদির্ষ্ট নিয়ম নেই। আসল কথা হল আমি কী মাছ ছাড়ব, কত বড় করে কতদিনে বাজরে বিক্রি করব, যেমন ধরুন- নাইলোটিকা মাছের চাষ করব। বাজারে বিক্রিযোগ্য সাইজ ১০০ গ্রাম। আমি উৎপাদন করব প্রতি ঘনমিটারে ১০ কেজি। সেখানে পোনা ছাড়ব প্রতি ঘনমিটারে ১০০টা + ৫% mortality বা ধরে নিব মারা যাবে। তেমনিভাবে যদি আফ্রিকান মাগুর ছাড়তে চাই এবং লক্ষ্যমাত্রা প্রতি ঘন মি. ১৫ কেজি এবং প্রতিটা মাছের গড় ওজন ২৫০ গ্রাম। তবে সেখানে পোনাছাড়তে হবে। ৬০টা + ৫%।

দৈনিক কী পরিমাণ খাদ্য দিবেন:

মাছ খাঁচায় মজুদের পর হতে বাজারজাত করার পূর্ব পর্যন্ত দৈহিক ওজনের বিবেচনায় খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা ৩% হতে সর্বোচ্য ৮% এর মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। একটি মাছ তার দৈহিক ওজনের গড়ে ৩-৫% বা তার একটু বেশি খাদ্য গ্রহন করে। তবে ১ গ্রাম থেকে ২০ গ্রাম পর্যন্ত পৌছতে ১০-২০% পর্যন্ত খাদ্য খায় এবং এই সময় তবে বাড়তিও বেশি হয়, মাছের ওজন ৩০০-৫০০ গ্রাম হওয়া পর্যন্ত সম্পূরক খাদ্য প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে। গড়ে সুষম খাদ্য দিয়ে ১ কেজি মাছ উৎপাদন করতে ১.৫/২.০০ কেজি খাদ্য দরকার হয়। তবে খাবারের সাথে সাথে কাঁচা গোবর, মুরগীর বিষ্ঠা ও প্রচুর ঘাস দিলে খাদ্য খরচ অনেক কমে যায়।

খাঁচয় কিভাবে মাছ চাষ করবেন

উৎপাদন ও সম্ভাবনা:

পতিত জমিতে (নদী, হাওর, বিল) মাছের উৎপাদন সাধারণ জমিতে স্থাপিত খামারের তুলনায় প্রায় ২০ গুণ বেশি হয়। সাধারণ পুকুরে বা খামারে এক একরে যে পরিমাণ মাছ চাষ করা যায় সেই পরিমাণ মাছ উৎপাদনের জন্য খাঁচায় মাত্র ১৮০ ঘনমিটার জায়গাই যথেষ্ট। খাঁচায় যেখানে প্রতি হেক্টরে তিন লাখ কেজি মাছ উৎপাদন সম্ভব, সেখানে পুকুরে বা খামারে প্রতি হেক্টরে মাত্র ২৩ হাজার কেজি মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে। বর্তমানে দেশের মাছের চাহিদা প্রতি বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন। খাঁচায় মাছ চাষ করলে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে মাত্র ১০ হাজার হেক্টর জমিই যথেষ্ট, যা আমাদের দেশের পতিত মোট নদ-নদীর পানির মাত্র শতকরা ০.২৫ ভাগ।খাচায় মাছের আকার ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম হতে সময় লাগে মাত্র ছয় মাস। এ ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটারে কমপক্ষে ৩০ কেজি মাছ উৎপাদিত হয়ে থাকে। সাধারণত চাষকৃত পোনার ওজন ১০ গ্রাম হয়ে থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে আকারে বড় অর্থাৎ ২০ থেকে ৩০ গ্রাম ওজনের পোনা চাষ করলে সর্বোচ্চ উৎপাদন পাওয়া যায়। খাঁচা তৈরি, পোনার মূল্য, খাদ্য, শ্রমিক ও অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে প্রতি ১০টি খাঁচা থেকে প্রতি ছয় মাসে কমপক্ষে এক লাখ ১০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।

পরিশেষে……

আমাদের দেশে প্রচুর উপযোগী নদী রয়েছে। সারা বছর খাঁচায় মাছ চাষ করে মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। আমাদের দেশে এবং বিদেশেও তেলাপিয়া মাছের প্রচুর চাহিদা আছে। আমাদের দেশের নদী কিনারায় বসবাসরত জনগণ বিশেষ করে দরিদ্র জেলেগোষ্ঠি শুধুমাত্র নদী থেকে প্রাকৃতিক মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এসব মৎসজীবীকে সংগঠিত করে মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব, সে সাথে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষ করে নদীর প্রাকৃতিক মৎস প্রজাতিগুলোর প্রজনন মৌসুমে তাদের নিবৃত্ত করে নদীর প্রাকৃতিক মাছের মজুদ বাড়ানো ও বিভিন্ন মাছের প্রজাতি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব। এশিয়ার অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও খাঁচায় উৎপাদিত মানসম্পন্ন তেলাপিয়া রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক তেলাপিয়া বাজারে প্রবেশের জন্য নীতিনির্ধারণী মহলসহ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ঠ সকলের এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন।