গরু মোটাতাজাকরণ: আমাদের খামারীরা কি ভুল পথে??

0
10153
চিত্র: স্বল্প মেয়াদে গরু মোটাতাজাকরণ এর জন্য আদর্শ
চিত্র: স্বল্প মেয়াদে মোটাতাজাকরণের জন্য আদর্শ গরু

সময়ের চাহিদা অনুযায়ী অন্যান্য প্রাণী বা গরু মোটাতাজাকরণ অবশ্যই একটি যুগোপযোগী প্রকল্প। এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করে ব্যবসায়িক সাফল্য লাভের অপার সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি দেশের বিপুল পরিমাণ প্রোটিনের ঘাটতি পূরণে এই খাত অপরিসীম অবদান রাখতে পারে। অতীব দুঃখের বিষয় হলো আজকাল মোটাতাজাকরণ খামারে গরু মোটাতাজা হলেও খামারীর অবস্থা দিন দিন কাহিল হয়ে যাচ্ছে! অনেক মোটাতাজাকরণ খামারী জানেনই না যে মোটাতাজাকরণ কি এবং এর উদ্দেশ্য কি। যার ফলে বর্তমানে এই সেক্টরে লাভবান খামারীর চেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ খামারীর সংখ্যাই বেশী দেখা যাচ্ছে।

গরু মোটাতাজাকরণ (ফ্যাটেনিং) কি?

ফ্যাটেনিং মূলত রোগা, শীর্ণাকায় গরু বা অন্য প্রাণী কিনে কিছুদিন যত্নআত্তি করে একটু স্বাস্থ্যবান করে বিক্রি করা। এটি একটি স্বল্পমেয়াদী প্রকল্প হয়ে থাকে এবং সেটাই হওয়া উচিৎ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইতিমধ্যেই এটি একটি লাভজনক ব্যবসা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যেহেতু মোটাতাজাকরণ একটি ব্যবসায়িক প্রকল্প সেহেতু এখানে অবশ্যই সবার আগে ব্যবসায়িক সাফল্য বিবেচনা করা উচিৎ। বর্তমানে নতুন নতুন খামারীরা সঠিক ব্যবসায়িক পরিকল্পনা না নিয়ে এই ব্যবসা শুরু করার কারণেই সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এজন্যই আমাদের আজকের আয়োজন গরু মোটাতাজাকরণ এবং এই সম্পর্কিত ব্যবসায়িক কৌশল প্রসঙ্গে।

ব্যবসায়িক পরিকল্পনা:

অবশ্যই সবার আগে আপনার একটি ভালো ও কৌশলী ব্যবসায়িক পরিকল্পনা থাকতে হবে। আজকাল অধিকাংশ খামারীই কুরবানী ঈদকে সামনে রেখে গরু মোটাতাজাকরণ করে থাকেন। এটার কিছু ভালো দিক থাকলেও বর্তমানে খারাপ দিকই বেশী দেখা যাচ্ছে। কুরবানী হাটে গরু বা অন্যান্য প্রাণীর চড়া মূল্য থাকে একথা সত্য তবে একথাও সত্য যে সেই চড়া মূল্য গরীব বা প্রান্তিক খামারীরা পায়না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবসাটা বিভিন্ন সিন্ডিকেটের হাতে চলে যায়। শুধুমাত্র কুরবানীর ঈদকে সামনে রেখে মোটাতাজাকরণ করলে যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তা হলো-

১. বছরে একবার আয়:

শুধুমাত্র কুরবানীর ঈদকে সামনে রেখে মোটাতাজাকরণ করলে সর্বপ্রথম যে সমস্যাটি হয় তাহলো আপনি সারা বছরে মাত্র একবারই সুযোগ পাবেন। অর্থাৎ কুরবানীর হাটে যদি আপনি আপনার পশু ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন তাহলে এককালীন কিছু লাভ ঘরে তুলতে পারবেন। আর কুরবানীর হাটে পশু বিক্রি করে লাভবান হতে না পারলে আপনার একটি বছর একদমই বৃথা হয়ে যাবে এবং আপনি যদি আপনার ব্যবসায়িক পরিকল্পনা পরিবর্তন না করেন তাহলে আপনাকে লাভের মুখ দেখার জন্য অবশ্যই আবার একটি বছর অপেক্ষা করতে হবে। তবে পরের বছর যে আপনি নিশ্চিতভাবে লাভবান হবেন সে গ্যারান্টি কিন্তু আপনাকে কেউ দিতে পারবেনা! সুতরাং দেখা যায় যে কোনোভাবেই ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক খামারীদের জন্য শুধুমাত্র কুরবানীকে সামনে রেখে মোটাতাজাকরণ করা কোনো অবস্থাতেই ভালো ব্যবসায়িক পলিসি হিসেবে গণ্য হতে পারেনা।

স্বল্প মেয়াদে মোটাতাজাকরণের জন্য এমন গরু নির্বাচন করতে পারেন
চিত্র: স্বল্প মেয়াদে মোটাতাজাকরণের জন্য এমন গরু নির্বাচন করতে পারেন

২. সারা বছরের খরচ:

কুরবানীকে সামনে রেখে মোটাতাজাকরণ করলে আপনাকে সারাবছর পকেটের টাকা বিনিয়োগ করে যেতে হবে যেটা আসলেই খুব কঠিন। অনেক খামারী দেখা যায় উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণ করেন যা পরবর্তীতে তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাড়ায়। কুরবানীর বাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বিপুল সংখ্যক খামারীই খরচ উসুল করে লাভের মুখ দেখতে পারেন না। যারা মোটামুটি লাভবান হন তারা আবার হিসাবের মধ্যে নিজের সারা বছরের শ্রম ধরেন না বা গোয়াল যে জমির উপর নির্মিত সেই জমির ভাড়া বাবদ কোনো টাকা ধরেন না। এগুলো ধরলে তাদেরও লাভের অঙ্ক শূন্যের কোটার নেমে আসবে।

৩. বড় জাতের গরুর প্রতি অদম্য ঝোঁক:

ইদানিং দেখা যাচ্ছে ছোট বড় প্রায় সকল খামারীই বড় জাতের গরু পালনের জন্য একেবারে পাগল। অথছ কুরবানীর বাজারে মাঝারি আকারের গরু গুলোর চাহিদা সবচেয়ে বেশী এবং এগুলো তুলনামূলক চড়া দামে বিক্রি হয়। বড় জাতের গরু যেমন সিন্ধী, শাহীওয়াল, ব্রাহমা, জার্সি, ফ্রিজিয়ান ইত্যাদি গরু পালনে যে লাভ নেই তা নয়, তবে এগুলোর বাজারজাতকরণ প্রান্তিক খামারীদের জন্য অনেক কঠিন। তাছাড়া এইসব জাতের গরুর বাছুর কেনা অনেক ব্যয়বহুল এবং লালনপালন খরচ ও খুব বেশি।

চেহারায় হয়তো রূপবান নয়, তবে মাস তিনেক যত্ন নিলে সেও কিন্তু একজন রোমিও হয়ে উঠতে পারে!
চিত্র: চেহারায় হয়তো রূপবান নয়, তবে মাস তিনেক যত্ন নিলে সেও কিন্তু একজন রোমিও হয়ে উঠতে পারে!

লাভবান হতে যে কৌশল অবলম্বন করতে পারেন:

লাভবান হতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই কৌশলী হতে হবে। অধিকাংশ মোটাতাজাকরণ খামারীরা যখন বাজারে বড় গরুর পিছনে ছুটবে আপনি তখন একটু আলাদা কাজ করুন। বাজারে একদম খাঁটি দেশি গরু, যাদের পাজরের হাড় গুনে নেওয়া যায়, যাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না এমন গরুর কাছে যান। অন্যরা যখন ৫০/৬০ হাজার টাকায় একটা পিওর সিন্ধি, শাহীওয়াল, জার্সি, ফ্রিজিয়ান বা ক্রস গরুর বাছুর নিয়ে বাড়ি ফিরবে আপনি তখন এই ৫০/৬০ হাজার টাকায় তিনটা দেশী গরু কিনে ফেলুন। এবার আপনার কেনা গরুগুলোর পাজরের হাড্ডি গুনতে গুনতে বাড়ি চলে আসুন।

যিনি উন্নত জাতের বাছুর কিনেছেন তার প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর। আপনার দেশী গরু পালনের মেয়াদ ঠিক তিন মাস। অর্থাৎ তিন মাস যত্নখাতির করে, পাজরের হাড়গুলো মাংস দিয়ে ঢেকে বিক্রি করে ফেলুন! মনে রাখবেন সারাবছর কিন্তু গরুর মাংসের কেজি ৫০০ টাকার আশেপাশেই থাকে যেটা আরো বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া কমার কোনো লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছেনা। এভাবে তিন মাস পর বিক্রি করলে আশা করা যায় আপনি খরচ বাদে প্রতি গরু থেকে কমপক্ষে ৫০০০/- টাকা লাভ করতে পারবেন, এমনকি ১০,০০০/- টাকা বা তার বেশি লাভ করা মোটেও অস্বাভাবিক কিছুনা। তাহলে আপনার তিনটা গরু থেকে সব খরচ বাদে কমবেশি তিন মাসে ৫০০০X৩ = ১৫,০০০/- টাকা লাভ করতে পারবেন। তারচেয়ে বড় ব্যাপার হলো আপনি বছরে ১২ মাসে মোট ৪ বার  বিক্রি করতে পারবেন। অর্থাৎ প্রতি বারে যদি আপনি ১৫ হাজার টাকাও লাভ করতে পারেন তাহলে বছরে মোট চার বারে ১৫,০০০X৪ = ৬০,০০০/- টাকা লাভ করতে পারবেন।

খেয়াল করুন, যিনি ৫০/৬০ হাজার টাকায় একটি ভালো জাতের বাছুর কিনেছিলেন তিনি যদি অস্বাভাবিক লাভ ও করেন তবুও সকল খরচ বাদ দিয়ে ৬০,০০০/- টাকার মত লাভ করতে পারবেন না একথা অনেকটা নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়। আর যদি তিনি কুরবানীর হাটে ভালো দামে বিক্রি করতে না পারেন তাহলে তো তার সারা বছরটাই মাটি। আমও গেলো, ছালাও গেলো……

এমন গরু আপনাকে আঙ্গুল ফুলিয়ে কলাগাছ বানাতে না পারলেও অন্তত হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে দেবেনা!
চিত্র: এমন গরু আপনাকে আঙ্গুল ফুলিয়ে কলাগাছ বানাতে না পারলেও অন্তত হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে দেবেনা!

স্বল্প মেয়াদে দেশী গরু মোটাতাজাকরণের অন্যান্য সুবিধাবলী:

১. দেশী গরুর খাবার ও চিকিৎসা খরচ তুলনামূলকভাবে খুবই কম, তাই এই খাতে আপনার খরচ অর্ধেকের ও কম হবে।

২. স্বল্প মেয়াদী প্রকল্প হওয়ায় আপনি এক বছরে মোট অন্তত চারবার সুযোগ পাচ্ছেন, অর্থাৎ এক চালানে যদি কোনোভাবে লস হয়ে যায় তবুও আপনার সামনে আরো তিনটি সুযোগ থাকবে সেটা কাটিয়ে উঠার। শুধু কুরবানী সামনে রেখে মোটাতাজাকরণ করলে যদি ভালো দামে বিক্রি করতে না পারেন তাহলে আপনার পুরো বছরটাই মাটি, কাটিয়ে ওঠার আর কোনো সুযোগ থাকবেনা।

৩. বড় জাতের একটা গরুতে যদি লস হয় তাহলে তো লস হয়েই গেলো। কিন্তু সেই টাকায় আপনি যখন তিনটা দেশী গরু পালন করছেন তখন একটা যদি লসে বিক্রি করেন তারপরও আপনার হাতে আরো দুইটা গরু আছে। সেগুলোতে লাভ করতে পারলেই বাজিমাৎ!!

৪. মনে রাখবেন, কুরবানীর হাটে ৭০/৭৫% ক্রেতাই কিন্তু মাঝারী সাইজের দেশী গরু কিনতে আসেন এবং তুলনামূলক সবচেয়ে চড়া দামে বিক্রি হয় দেশী জাতের মাঝারি সাইজের গরু!!

প্রিয় খামারী ভাইয়েরা, আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করেছি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারীদেরকে ব্যবসায়িকভাবে সফল হওয়ার জন্য কিছু যুক্তিসঙ্গত পরামর্শ দেওয়ার। এখন আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কুরবানী ঈদকে সামনে রেখে পুরো একটা বছর, শ্রম, অর্থ বাজি ধরবেন নাকি স্বল্প মেয়াদে ঝুকিমুক্ত ব্যবসা করবেন। সকল খামারী ভাইদের জন্য শুভকামনা রইলো।

আমাদের নতুন পোস্টের আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন ও ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করুন।

**পরবর্তী প্রবন্ধে আমরা লাভজনক ছাগল মোটাতাজাকরণ নিয়ে আলোচনা করবো।

Molla Masum
নির্বাহী সম্পাদক
সফলখামারী.কম

*ছবি: ইন্টারনেট