সবজির অর্থনৈতিক ও ভেষজ গুরুত্ব

0
3613
সবজির অর্থনৈতিক ও ভেষজ গুরুত্ব

সবজির অর্থনৈতিক ও ভেষজ গুরুত্ব

আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে, স্বাস্থ্যরক্ষা ও কর্মক্ষম থাকার জন্য আমাদের বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের প্রয়োজন। কারণ প্রয়োজনীয় পুষ্টি ব্যতীত কেউ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারেন না। শাক- সবজি মানব পুষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখার পাশাপাশি সবজি চাষ আমাদের দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। আসুন এবার আমরা সবজি চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিকে দৃষ্টিপাত করি।

(ক) অধিক লাভের উৎস:

মাঠ ফসলের তুলনায় সবজি চাষ আমাদের দেশের ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষীদের জন্য অধিক লাভ বয়ে নিয়ে আসতে পারে। গবেষণা করে দেখা যায় যে হেক্টর প্রতি আলু, টমেটো এবং ফুলকপি চাষ করে খরচ বাদে নিট লাভ যথাক্রমে১১,১৫ এবং ১৬ হাজার টাকা হতে পারে। অথচ দেখা যায় একই পরিমান জমি হতে একজন কৃষক ধান ও গম চাষ করে যথাক্রমে মাত্র হাজার ২:৫থেকে৫ হাজার টাকা লাভ করতে পারে। শাক সবজি চাষ করতে অধিক মুলধনের প্রয়োজন হলে ও বাড়তি মূলধন যোগাড় করা আজ আর সমস্যা নয়। এ ব্যাপারে সরকারী ও বেসরকারী অর্থলগ্নিসংস্থা এগিয়ে এসেছে।

(খ) ধান ও গমের বিকল্প হিসাবে সবজি ব্যবহার করে খাদ্য ঘাটতি পূরণ ও বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় সংকোচন:

আমাদের দেশে ফসল উৎপাদনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিত্য দিনের সঙ্গী। দেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৫-২০ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে খাদ্যশস্য আমদানি করে সরকারকে এ ঘাটতি মেটাতে হয়। আার এ কারনেআমাদের জাতীয় উন্নতি অনেকাংশে ব্যাহত হয়। এমতাবস্থায় ধান ও গমেরপরিবর্তে শর্করা সমৃদ্ধ সবজি যেমন- গোল আলু, মিষ্টি আলু ইত্যাদি খেয়ে আমরা খাদ্য ঘাতটি পূরণ করে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে পারি। উল্লেখ্য যে, আলু ও মিষ্টি আলু উৎপাদনে ধানের জমির ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।চাষাবাদে ধানের তুলনায় সামান্য ক্ষেতের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া আলু, মিষ্টি আলু সস্তা বিধায় সীমিত আয়ের জনসাধারনের সুষম খাদ্যের চাহিদা পূরণে ভাতের বিকল্প থাবার হিসাবে আলু ও মিষ্টি আলু বেশি খাওয়া দরকার।

(গ)বৈদেশিক মুদ্রা আয়:

সম্ভাবনাময় আমাদের দেশ এই বাংলাদেশ। এ দেশের মাটি, আবহাওয়া ও জলবায়ু  ফসল উৎপাদনে অত্যন্ত উপযোগী। পৃথিবীর অনেক দেশেই উপযুক্ত জলবায়ুর অভাবে শাক-সবজি চাষ হচ্ছে না। শীতকালে শীত প্রধান দেশে খোলা মাঠে কোন শাক-সবজি জন্মানো সম্ভব হয় না। এসময় তারা কাঁচের ঘর বা গ্রীন হাউজে কৃত্রিম আবহাওয়া সৃষ্টি করে কিছু শাক-সবজি উৎপাদন করে। এ ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে। আবার অত্যধিক গ্রীষ্ম প্রধান স্থান যেমন – মধ্য-প্রাচ্যে বিদ্যমান আবহাওয়ার কারণে শাক-সবজি উৎপাদন করা সম্বব হয় না। এ তুলনায় বাংলাদেশের জলবায়ু বিশেষ করে শীতকালে নানা রকম শাক-সবজি চাষের বিশেষ উপযোগী। এ দেশের কিছু সবজি (কচু, কুমড়া, মসলা, আদা-হলুদ ) বিদেশে রপ্তানির প্রচুর সুযোগ আছে। এ সম্ভাবনাময় সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে ও আমরা বাড়তি শাক-সবজি বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারি। ইদানিংকালে আমাদের দেশ হতে বিদেশে শাক-সবজি রপ্তানী শুরু হয়েছে যা একদিকে যেমন দেশের জাতীয় আয় তরান্বিত হচ্ছে তেমনটি অন্যদিকে কর্মসংস্হানের ও সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

(ঘ) পতিত জমির সদ্ব্যবহার:

সবজি চাষে আয় বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের পাশাপাশি পতিত জমির সদ্ব্যবহার হয়ে থাকে। আমাদের দেশের বাড়ির আনাচে-কানাচে, অফিস, স্কুল ও প্রাঙ্গনে, রাস্তা, বাঁধ ও রেল লাইনের ধারে অনেক পতিত জমি রয়েছে। এ জমিগুলো ধান, গম ইত্যাদি চাষের জন্য তেমন উপযোগী নয়। এসব স্থান শাক-সবজি উৎপাদনের জন্য বিশেষ উপযোগী। একটু যত্ন নিয়ে এসব জায়গায় শাক-সবজি চাষ করে আমরা পতিত জমির সঠিক ব্যবহার সহ বাড়তি আয়ের সংস্থান করতে পারি। এ ছাড়াও বেলে ভাবাপন্ন ছায়া, আধাছায়া, অসমতল, ইত্যাদি ধরনের পতিত জমি ও সবজির প্রকার ও উপযুক্ততা নির্ণয় করে আদা-হলুদ, কচু ইত্যাদি মসলা ও সবজি আবাদের আওতায় আনা সহজতর।

(ঙ) বেকার সমস্যার সমাধান:

 ধান, গম, পাট ইত্যাদির তুলনায় শাক-সবজি চাষ করতে অধিক শ্রমিক প্রয়োজন হয়। আর তাই অধিক শাক-সবজি চাষ করে আমাদের দেশের উদ্ধৃত শ্রম কাজে লাগিয়ে বেকার সমস্যার বেশ সমাধান ও দিতে পারে। বিশেষ করে মহিলাদেরকে বাড়ির আঙ্গিনা সবজি চাষে বেশি উৎসাহিত করে মহিলা জন শক্তিকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানো যায়।

(চ) নতুন শিল্পের সৃষ্টি ও বিকাশ:

বছরব্যাপী সবধরনের শাক-সবজি পাওয়ার লক্ষ্যে উন্নত দেশগুলোতে আধুনিক খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের প্রসার লাভ করেছে। কারণ সবধরনের শাক-সবজি বছেরর সব সময় জন্মানো সম্ভব নয়। আমাদের দেশেও বর্তমান এসব শিল্পের প্রতি নজর দেওয়া হচ্ছে। অধিক শাক-সবজি উৎপাদন করে  আমরা  বিভিন্ন  ধরনের  প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য তৈরী করে একদিকে যেমন দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করতে পারি, অন্যদিকে সেই সব প্রস্তুত খাদ্যদ্রব্য বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি।  এক্ষেত্রে নতুন শিল্পের সৃষ্টির  মাধ্যমে বেকারত্ব দুর  হচ্ছে  অপর দিকে  দেশের জাতীয় আয় তরান্বিত হচ্ছে।

সবজি চাষের মৌসুম প্রসারিত করে  অধিক আয়ের সম্ভাবনা:

আমাদের দেশে জন্মানো  সবজিগুলো মুলত মৌসুম ভিত্তিক। শীতকালে জন্মানো সবজি গ্রীষ্মকালে জন্মানো যায় না। তবে এদের মধ্যে কিছু কিছু সবজি রয়েছে যেগুলোর বেশ আগাম ও বিলম্বিত চাষ সম্ভব। এছাড়া কিছু নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে এক মৌসুমের সবজি অন্য মৌসুমে চাষাবাদ সম্ভব হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ টমেটোর কথা বলা যেতে পারে। বর্তমানে টমেটো গ্রীষ্মকালেও চাষাবাদ সম্ভব হচ্ছে আবার দিনাজপুর অঞ্চলে যেখানে বৃষ্টিপাত কম অথবা বিলম্বিত বৃষ্টি হয় না, সেখানে শীতকালীন সবজি আগাম চাষের মাধ্যমে অক্টোবর মাসে সবজি বাজারজাতকরণ সম্ভব হচ্ছে। এভাবে চাষের মৌসুমকে প্রসারিত করে কৃষকরা সবজি চাষে অধিক আয়ের সম্ভাবনা খুঁজে পেতে পারেন।

 সবজির ভেষজ গুরুত্ব:

পুষ্টি উপাদান ছাড়াও শাক-সবজির অনেক ভেষজ গুরুত্ব রয়েছে। ভেষজ ওষুধের অবদান ও গুরুকে অস্বীকার করে আধুনিক চিকিৎসা ও ওষুধের বর্তমান অবস্থানকে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কারণ সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ভেষজ ওষুধ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। নব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে ভেষজ ওষুধ প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছে। শাক-সবজিতে উপস্থিত বিভিন্ন অম্ল জৈব যেমন- অক্সালিক এসিড (পালং শাক, মটরশুটি), ফলিক এসিড (টমেটো, লেটুস, ফুলকপি) সাইট্রিক এসিড (লেটুস, পালং শাক) ইত্যাদি মানুষের খাওয়ার রুচি এবং হজম শক্তি বাড়ায়। পেঁয়াজের রস এন্টিবায়োটিক হিসাবে কাজ করে। মাথারখুশকি দূরীকরণে এবং পোকামাকড়ের কামড়ের জ্বালা হতে অভ্যাহতি পাওয়ার জন্য এটি বিশেষ কার্যকর। প্রতিনিয়ত পেঁয়াজ খেলে চর্ম রোগ হতে অব্যাহতি পাওয়া যায়। রসুন রক্তের কোলেস্টেরল কমায়, হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে এবং বাত রোগের উপশম ঘটায়।  মুখি কচু ক্ষারযুক্ত খাদ্য বলে অম্লরোগে এর ব্যবহার উপকারী। মানকচু ভক্ষণ বাতরোগ উপশমে বেশ কাজ করে। থানকুনি-পুদিনা আহারে নানা রকম রোগ প্রতিরোধক শক্তি বাড়ায়। সবজিতে প্রচুর পরিমানে আঁশ আছে বিধায় নিয়মিত এর ভক্ষণ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, সবজি চাষে নীট লাভ হয় ধান ও গমের তুলনায় প্রায় তিন গুন বেশি। ধান ও গমের বিকল্প খাবার  হিসেবে আলু ও মিষ্টি আলুর ব্যবহার আমাদের দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করতে পারে। পুষ্টিহীনতা দুরীকরণের পাশাপাশি অধিক সবজি চাষে বেকার শ্রমিকের ব্যবহার সম্ভব হয়।

 

 

পরিকল্পিত উপায়ে সবজি চাষ করলে দেশে,

বাংলার কৃষকগোষ্ঠি অধিক লাভবান হবে তাতে।

সস্তায় সুষম খাবার চান,

ডাল ভাত তেল আর সবজি খান।