কিভাবে স্ট্রবেরি চাষ করবেন: স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি

0
8893
কিভাবে স্ট্রবেরি চাষ করবেন: স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি

স্ট্রবেরি (Fragaria ananasa) হচ্ছে Rosaceae পরিবারভুক্ত একটি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। স্ট্রবেরি মূলত শীতপ্রধান অঞ্চলের ফল হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের যেসব এলাকায় শীত বেশি পড়ে ও অনেক দিন স্থায়ী হয় সেসব এলাকায় বারি স্ট্রবেরি-১ নামে একটি উচ্চফলনশীল জাতের স্ট্রবেরি চাষ করা হচ্ছে। আসুন জেনে নেয়া যাক স্ট্রবেরি চাষ সর্ম্পকে।

পুষ্টিমান:

স্ট্রবেরি অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি রসালো ফল। এ ফলে পানি, খাদ্যশক্তি, আমিষ, চর্বি, শর্করা, অশোধিত আঁশ, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, লৌহ, ভিটামিন-সি, নিয়াসিন ও ভিটামিন-এ রয়েছে।

স্ট্রবেরি ফলের বৈশিষ্ঠ্য:  স্ট্রবেরি ফলটি কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পাকা অবস্থায় লাল টকটকে রঙের হয়। এ ফলটি দেখতে অনেকটা লিচুর মত, স্বাদের দিক দিয়ে টক মিষ্টি এবং সুগন্ধীযুক্ত।

স্ট্রবেরি গাছের বৈশিষ্ঠ্য:

স্ট্রবেরি গাছ দেখতে অনেকটা থানকুনি অথবা আলুর গাছের মত, তবে এ গাছের পাতা আরো বড় এবং চওড়া। স্ট্রবেরি থানকুনি গাছের মতই রানারের মাধ্যমে চারা চারদিকে ছড়াতে থাকে এবং পাশ থেকে বের হওয়া পরিণত রানার কেটে আলাদা লাগিয়ে এর চাষ করা যায়। তবে এর বীজ বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে। একটি স্ট্রবেরি গাছ থেকে রানারের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি করলে বছরে কয়েকশত চারা উৎপাদন করা সম্ভব।

জাত:  শীতপ্রধান দেশের হলেও বহুবর্ষজীবী বিরুৎ জাতীয় গাছ স্ট্রবেরির এখন চাষ হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে। স্ট্রবেরি প্রচুর পুষ্টিগুণসম্পন্ন ও সুস্বাদুর  জন্যই সারা বিশ্বে এর এই ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। নিম্নে এ ফলের জাতের নাম ও চাষের সময় উল্লেখ করা হল:-

জাতের নাম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম চাষের সময়
বারি স্ট্রবেরি-১ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ
রাবি-১, রাবি-২ এবং রাবি-৩ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর
মর্ডান স্ট্রবেরি-১, মর্ডান স্ট্রবেরি- ২, মর্ডান স্ট্রবেরি- ৩, মর্ডান স্ট্রবেরি- ৪ (Camarosa),  মর্ডান স্ট্রবেরি- মর্ডান হর্টিকালচার সেন্টার, নাটোর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর

 

জমি তৈরি:

দোআঁশ ছায়ামুক্ত বেলে দোআঁশ মাটি, উঁচু এবং পানি নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এরুপ স্থান স্ট্রবেরি চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। চাষের আগে জমির মাটি পরীক্ষা করে নেওয়া ভাল। জমি ভালভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে অন্তত ৩০ সেন্টিমিটার গভীর করে চাষ দিয়েজমিতে প্রয়োজনীয় জৈবসার ও রোগ প্রতিরোধক ঔষধ দিয়ে জমিকে সুষম গুণসম্পন্ন করে তুলতে হবে । স্ট্রবেরি চাষে জমির পিএইচমান কম হলে জমিতে চুন দিয়ে জমির পিএইচ বাড়াতে হবে। স্ট্রবেরির জন্য মাটির পিএইচ মান ৬.০ থেকে ৭.০ হলে ভাল হয়।

চারা তৈরি: স্ট্রবেরি ভাল মানের চারা পেতে হলে বিশ্বস্ত কোনো নার্সারি থেকে সংগ্রহ করতে হবে কারণ স্ট্রবেরির চারা এখনও তেমন সহজলভ্য নয়। স্ট্রবেরি গুল্ম জাতীয় গাছ তাই এর গোড়া থেকে বেশ কিছু লম্বা লতা বেরিয়ে আসে, এবং বেরিয়ে আসা এই লতার গিঁট মাটির সংস্পর্শে এসে শেকড় গজিয়ে চারায় পরিণত হয়। এই শিকড়যুক্ত গিঁট মাটিতে পুঁতে নতুন চারা তৈরি করা হয়।  অর্ধেক মাটি অর্ধেক গোবর সার মিশিয়ে পলিব্যাগে ভরে একটি করে শিকড়যুক্ত গিটসহ লতা পুঁতে দিতে হয়। উল্রেখ্য যে একটি  স্ট্রবেরি গাছ থেকে ১৮-২০ টি চারা তৈরি করা সম্ভব।

স্ট্রবেরি চাষ
চিত্র: স্ট্রবেরির গাছ

স্ট্রবেরি চারা রোপন এর সময়:

স্ট্রবেরির চারা নভেম্বর মাস রোপণের জন্য সবচেয়ে ভাল। তবে মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য ডিসেম্বর পর্যন- রোপণ করা যায়। স্ট্রবেরি জমি তৈরির পর লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব হবে ৫০ সেন্টিমিটার এবং প্রতি সারিতে ৩০ সেন্টিমিটার পর পর স্ট্রবেরির চারা লাগাতে হয় এবং প্রতি সারির মাঝখানে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হয়।

সার ব্যবস্থাপনাঃ স্ট্রবেরির চাষ করার জন্য দরকার প্রচুর জৈব সার। তাই প্রতি একরে ৫০-৬০ কেজি ইউরিয়া সার, ৭০ কেজি টিএসপি সার এবং ৮০ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। এসব সারকে সমান দুভাগে ভাগ করে একভাগ দিতে হবে  ফুল আসার একমাস আগে এবং অন্য ভাগ দিতে হবে ফুল ফোটার সময়।

আগাছা: স্ট্রবেরির চাষ করার  জমি সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে।

সেচ ব্যবস্থা: চাষের জমিতে রস না থাকলে সেচ দিতে হবে এবং ফল ধরা শুরু হলে ২-৩ দিন পর পরই সেচ দিতে হবে।

নিষ্কাশন: চাষের জমিতে বৃষ্টি বা সেচের অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। উল্রেখ্য যে স্ট্রবেরি জলাবদ্ধতা মোটেই সহ্য করতে পারে না।

 রোগবালাইনাশক ও পশুপাখি:

রোগবালাইনাশক ও পশুপাখি স্ট্রবেরি চাষে বিরাট অন্তরায়। স্ট্রবেরি গাছকে পশুপাখি থেকে রক্ষার জন্য জমির চারপাশে জাল দিয়ে ভালভাবে ঘিরে দিতে হবে। কেননা পাখিরা স্ট্রবেরি ফুল ফল খুবই পছন্দ করে, তাদের আটকানো না গেলে ক্ষেত যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঠিক তেমনি কৃষক তার কাঙ্খিত ফলন থেকে বঞ্চিত হবে তাই এদের আটকাতে হবে। এদের হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করার জন্য  জাল ব্যাবহারের ক্ষেত্রে মোটা সুতার জাল ব্যবহার করতে হবে কেননা নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যাবহার করলে পাখি আটকা পড়ে মারা যেতে পারে। তাই উল্লেখ্য যে গাছে পোকার আক্রমণ হলে অল্প মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।

 ফল সংগ্রহ:

স্ট্রবেরি ফল সাধারনত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকেই পাকতে শুরু করে। গাছের কাঁচা ফল যখন হলদে বা লালচে রঙের হতে শুরু করবে ঠিক তখনই বুঝা যাবে যে ফল পাকা শুরু হয়েছে।  স্ট্রবেরি ফল পুরো পাকলে লাল হয়ে যায়। তবে স্ট্রবেরি ফল বিক্রির জন্য পুরো লাল হওয়ার দরকার নেই। সেক্ষেত্রে ফলগুলো শক্ত থাকা অবস্থায় গাছ থেকে তুলতে হবে। লক্ষণীয় যে গাছ থেকে ফল তুলতে হবে বোটা সমেত। ফল তোলার পর ১০-১২ দিন পর্যন্ত উপযুক্ত পরিবেশে ভালো থাকে। প্যাকেজিং করার ক্ষেত্রে সাধারনত কাগজের কার্টুন বা প্লাস্টিক কেজ দারা প্যাকেজিং করা হয়ে থাকে। বাজারজাত করার জন্য সে ক্ষেত্রে কাগজের প্যাকেটে বা টিস্যু পেপার দিয়ে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের ঝুড়ি বা ডিমের ট্রে ব্যবহার করতে হয়।

 বাজার সম্ভাবনা :

স্ট্রবেরি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ফল। আকর্ষণীয় রঙ, গন্ধ ও উচ্চ পুষ্টিমানের জন্য বর্তমানে এ ফল খ্যাত। স্ট্রবেরি ফল হিসেবে সরাসরি খাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন খাবারের সৌন্দর্য ও সুগন্ধ বাড়ানোর জন্য এটা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বর্তমানে আমাদের দেশের বড় বড় শহরগুলোতে স্ট্রবেরির চাহিদা অনেক বেড়েছে। এ চাহিদা দিন দিন বাড়ার কারনে স্ট্রবেরি বেশি দামে বিক্রি করা যায় তাই এর চাষ খুবই লাভজনক। এছাড়া এ ফল উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত উৎপাদন বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ফল উৎপাদনে বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সহায়তা দিয়ে থাকে। সম্ভাবনাময় এ লাভজনক ফল উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।

***স্ট্রবেরি চাষ সর্ম্পকে আরো তথ্য জানতে আমাদের সংঙ্গে থাকুন।