বাংলাদেশে কোয়েল পালন ও এর জনপ্রিয়তা

0
3804
কোয়েল পালন
চিত্র : কোয়েল পালন

বাংলাদেশের আবহাওয়া কোয়েল পালনের জন্য উপযোগী তাই বাংলাদেশে কোয়েল পালন এখন অনেক জনপ্রিয়। জাপানি জাতের কোয়েল আকারে ছোট, উচ্চ হারে ডিম উত্পাদন করতে পারে এবং সহজেই পালন করা যায়। তাই এটি সারা পৃথিবীতে প্রচুর পরিমাণে চাষ করা হয়। অন্যান্য গৃহপালিত পাখির তুলনায় এর মাংস ও ডিম গুনগতভাবে শ্রেষ্ঠ। পোল্ট্রির এগারটি প্রজাতির মধ্যে এটি সবচেয়ে ছোট। আনুপাতিক হারে কোয়েল পাখির ডিমে প্রোটিন বেশি ও কোলেস্টেরল কম থাকে। জায়গা কম লাগে বলে ১টি মুরগীর পরিবর্তে ৮টি কোয়েল পালন করা সম্ভব। কাজেই অতি সহজে বাড়ীর আঙ্গিনায় বা ঘরের কোনে ১০-২০টি কোয়েল পালন করা যায়। কম খরচে, অল্প জায়গায়, অল্প খাদ্যে কোয়েল পালন করে পারিবারিক পুষ্টি যোগানের পাশাপাশি কিছু আয়ও করা সম্ভব।

এক নজরে কোয়েল পালনের সুবিধা:

  • কোয়েল দ্রুত বর্ধনশীল, ৬ থেকে ৭ সপ্তাহে খাওয়ার উপযোগী হয় ও ডিম পাড়া শুরু করে।
  • বছরে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে। প্রায় প্রতিটি থেকেই বাচ্চা পাওয়া যায়।
  • এর ডিমে প্রেটিনের পরিমাণ বেশি এবং কোলেস্টেরলের পরিমাণ কম।
  • এর দৈহিক ওজনের তুলনায় ডিমের শতকরা ওজন বেশি।
  • ১টি মুরগী পালনে যে পরিমাণ জায়গায় প্রয়োজন সেখানে ৮ থেকে ১০টি কোয়েল পালন করা যায়।
  • ১৭ থেকে ২০ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় এবং ৬ থেকে ৭ সপ্তাহে খাওয়ার উপযোগী হয় ও ডিম পাড়া শুরু করে।
  • এদের খাবার খুবই কম (দিনে ২০ থেকে ৩০ গ্রাম) লাগে এবং রোগ বালাই খুব কম হয়।
  • অল্প জায়গায়, কম পুঁজি বিনিয়োগ করে অল্প দিনে বেশি লাভ করা যায়।

কোয়েলের জাত নির্বাচন:

মাংস ও ডিম উৎপাদনের জন্য অন্যান্য পোল্ট্রির মতই কোয়েলেরও আলাদা আলাদা জাত রয়েছে। পৃথিবীতে কোয়েলের যতগুলো জাত রয়েছে তার মধ্যে এর আদি জাত “জাপানি কোয়েল” অন্যতম। কোয়েল পালনের জন্য এই জাত নির্বাচন করাই শ্রেয়।

প্রজনন:

ডিম ফুটানোর জন্য স্ত্রী ও পুরুষ কোয়েল একসাথে রাখতে হবে। ডিমের জন্য স্ত্রী কোয়েল পালন বেশি লাভজনক। ডিমের উবর্রতার মান ভালো রাখার জন্য ৩টি স্ত্রী কোয়েলের সাথে ১টি পুরুষ কোয়েল রাখার ৪ দিন পর হতে বাচ্চা ফুটানোর জন্য ডিম সংগ্রহ করতে হবে। স্ত্রী কোয়েল থেকে পুরুষ কোয়েল আলাদা করার ৩ দিন পর্যন্ত ফুটানোর জন্য ডিম সংগ্রহ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় কোয়েল ৬ থেকে ৭ সপ্তাহ বয়সে ডিম পাড়া শুরু করে। এবং ৮ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত ডিম পাড়া অপরিবর্তিত থাকে। উপযুক্ত পরিবেশে প্রথম বছর গড়ে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০টি ডিম পাড়ে। দ্বিতীয় বছরের ডিমের উৎপাদন প্রথম বছরের উৎপাদনের শতকরা ৪৮ ভাগ। কোয়েল ডিমের উবর্রতা শতকরা ৮২-৮৭ ভাগ। ডিম পাড়া শুরুর প্রথম ২ সপ্তাহের ডিম ফুটানোর জন্য বসানো উচিৎ নয়।

কোয়েলের বাচ্চার যত্ন  তাপ দেওয়া:

সদ্য ফুটন্ত কোয়েলের বাচ্চার ওজন মাত্র ৫-৭ গ্রাম হয়। এই সময় যেকোনো ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার কারণে এর দৈহিক বৃদ্ধি, ডিম উৎপাদন এবং বেঁচে থাকা ব্যহত হতে পারে। কাজেই এই সময়ে খাদ্যের প্রয়োজনীয় পুষ্টিমান ও তাপমাত্রা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বজায় রাখা উচিৎ। কোয়েলে বাচ্চাকে খাঁচায় ও লিটারে ব্রুডিং বা তাপ দেওয়া যায়।

ছক-১: ব্রুডিংকালীন প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা
ছক-১: ব্রুডিংকালীন প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা

ইনকুবেটরে বাচ্চা ফুটার ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাপ দেওয়ার ঘরে এনে প্রথমে গ্লুকোজ ও এমবাভিট ডলিউ এস পানির সাথে পর পর ৩ দিন খেতে দিতে হবে এবং এরপরে খাবার দিতে হবে। প্রথম সপ্তাহ খবরের কাগজ বিছিয়ে তার উপর খাবার ছিটিয়ে দিতে হবে এবং প্রতিদিন খবরের কাগজ পরিবর্তন করতে হবে। এক সপ্তাহ পর ছোট খাবার পাত্র বা ফ্লাট ট্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। মার্বেল বা পাথরের টুকরা পানির পাত্রে রাখতে হবে যাতে পানির পাত্রে বাচ্চা যাতে পড়ে না যায়। সবসময় পরিষ্কার পরিচছন্ন পানি দিতে হবে।

কোয়েলের বাসস্থান:

বাণিজ্যিকভাবে কোয়েল পালনের জন্য লিটার পদ্ধতির চেয়ে খাঁচায় পালন করা বেশি লাভজনক। প্রতিটি বাচ্চা কোয়েলের জন্য খাঁচায় ৭৫ বর্গ সেন্টিমিটার ও মেঝেতে ১০০ বর্গ সেন্টিমিটার জায়গার প্রয়োজন। আর প্রতিটি পূর্ণ বয়স্ক কোয়েলের জন্য খাঁচায় ১৫০ বর্গ সেন্টিমিটার ও মেঝেতে ২৫০ বর্গ সেন্টিমিটার জায়গা দরকার। কোয়েলের ঘরে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাপমাত্রা ৫০ থেকে ৭০ ডিগ্রী ফারেনহাইট রাখতে হবে। থার্মোমিটারের সাহায্যে এই তাপমাত্রা পরিমাপ করা যাবে। স্ত্রী কোয়েল এবং পুরুষ কোয়েল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৃথক পথৃক ভাবে রাখতে হবে।

খাচায় কোয়েল পালন
চিত্র : খাচায় কোয়েল পালন

খাঁচায় কোয়েল পালন:

৫০টি বয়স্ক কোয়েলের জন্য ১২০ সেঃ মিঃ দৈর্ঘ্য, ৬০ সেঃ মিঃ প্রস্থ এবং ৩০ সে মিঃ উচ্চতা বিশিষ্ট একটি খাঁচার প্রয়োজন। খাঁচার মেঝের জালিটি হবে ১৬-১৮ গেজি। ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত বাচ্চার খাচার মেঝের জালের ফাক হবে ৩ মিঃ মিঃ এবং বয়স্ক কোয়েলের খাঁচায় মেঝের জালের ফাক হবে ৫মিঃ মিঃ। খাচার দুই পার্শ্বে একদিকে খাবার পাত্র অন্যদিকে পানির পাত্র সংযুক্ত করে দিতে হবে। খাঁচায় ৫০টি কোয়েলের জন্য তিন সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত ২৫ সেঃ মিঃ বা ১০ ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট ২৮ বঃ সেঃ মিঃ বা ৩ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন।

খাদ্য ব্যবস্থাপনা:

বাচ্চা, বাড়ন্ত অথবা প্রজনন কাজে ব্যবহৃত কোয়েলের জন্য স্ট্যান্ডার্ড রেশন বাজারে সহজলভ্য নয়। কোয়েলের রেশনকে তিনভাগে ভাগ করা যায়, যথাঃ স্টার্টার, বাড়ন্ত, এবং লেয়ার বা ব্রিডার । ডিম পাড়া কোয়েলের প্রতি কেজি খাবারে ২.৫-৩.০% ক্যালসিয়াম থাকতে হবে। ডিমের উৎপাদন ধরে রাখার জন্য গরমের সময় ৩.৫% ক্যালসিয়াম প্রয়োজন।

খাবার পাত্র:

বাচ্চা অবস্থায় ফ্লাট ট্রে বা ছোট খাবার পাত্র দিতে হবে যেন খাবার খেতে কোন রকম অসুবিধা না হয়।প্রতি ২৮ টি বাচ্চার জন্য একটি খাবার পাত্র (যার দৈর্ঘ্য ৫০ সেঃ মিঃ, প্রস্থ’ ৮ সেঃ মিঃ এবং উচ্চতা ৩ সেঃ মিঃ) এবং প্রতি ৩৪ টি বয়স্ক কোয়েলের জন্য একটি খাবার পাত্র (যার দৈর্ঘ্য ৫৭ সেঃ মিঃ, প্রস্থ ১০ সেঃ মিঃ এবং উচ্চতা ৪ সেঃ মিঃ) ব্যবহার করা যেতে পারে। সকালে এবং বিকালে খাবার পাত্র ভাল করে পরিষ্কার সাপেক্ষে মাথাপিছু দৈনিক ২০-২৫ গ্রাম খাবার দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, পথ্রম সপ্তাহ থেকে ৫ গ্রাম দিয়ে শুরু করে প্রতি সপ্তাহে ৫ গ্রাম করে বাড়িয়ে ২০-২৫ গ্রাম পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে। প্রতিটি বয়স্ক কোয়েলের জন্য ১.২৫-২.৫ সেঃ মিঃ (১/২ থেকে ১ ইঞ্চি) খাবার পাত্রের জায়গা দিতে হবে।

পানির পাত্র:

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পাত্রে পরিষ্কার পানি প্রদান করতে হবে এবং সবসময় তা পরিষ্কার রাখতে হবে। প্রতিটি বয়স্ক কোয়েলের জন্য ০.৬ সেঃ মিঃ (১/৪ ইঞ্চি) পানির পাত্রের জায়গা দিতে হবে। অটোমেটিক বা যেকোনো রকম পানির পাত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতি ৫০টা কোয়েলের জন্য একটি পানির পাত্র দেয়া উচিত। নিপল ড্রিংকার বা কাপ ড্রিংকারও ব্যবহার করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রতি ৫টি বয়স্ক কোয়েলের জন্য ১টি নিপল বা কাপ ড্রিংকার ব্যবহার করা যেতে পারে।

লিটার ব্যবস্থাপনা:

তুষ, বালি, ছাই, কাঠের গুড়া প্রভৃতি দ্রব্যাদি কোয়েলের লিটার হিসাবে মেঝেতে ব্যবহার করা যায়। অবস্থাভেদে লিটার পরিবর্তন করতে হবে যাতে অপরিচ্ছন্ন না থাকে। মেঝেতে ডীপ লিটার পদ্ধতি করা ভাল। প্রমেই ৫-৬ ইঞ্চি পুরু তুষ বিছিয়ে দিতে হবে এবং লক্ষ্য রাখতে হবে যেন লিটার ভিজা না থাকে। শীতকালে লিটার পরিবর্তন ও স্থাপন করতে হবে। অন্য ঋতুতে লিটার পরিবর্তন ও স্থাপন করলে লিটারের শতকরা ১-২ ভাগ কলি চুন মিশিয়ে দিতে হবে যেন লিটার শুস্ক এবং জীবাণু মুক্ত থাকে।

আলোক ব্যবস্থাপনা:

কাংখিত ডিম উৎপাদন এবং ডিমের উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য দৈনিক ১৪-১৮ ঘন্টা আলোক প্রদান করা প্রয়োজন। শরৎকালে এবং শীতকালে দিনের আলোক দৈর্ঘ্য কম থাকে তাই কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করা হয়। পুরুষ কোয়েল যেগুলো প্রজনন কাজে ব্যবহার করা হয় না এবং যেগুলো শুধুমাত্র মাংস উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয় সেগুলোর জন্য দৈনিক ৮ ঘন্টা আলোই যথেষ্ট।

ছক-২: বয়সের বাড়ার সাথে আলোক প্রদান

রোগ বালাই:

কোয়েলের রোগবালাই নেই বললেই চলে। সাধারণত কোনো ভ্যাকসিন অথবা কৃমিনাশক ঔষধ প্রয়োজন হয় না। তবে বাচ্চা ফুটার প্রথম ২ সপ্তাহ বেশ সংকটপূর্ণ। এই সময়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কোয়েলের বাচ্চার যত্ন নিতে হবে। কারণ অব্যবস্থাপনার কারণে কোয়েলের বাচ্চা মারা যায়, তবে বয়স্ক কোয়েলের মৃত্যুহার খুবই কম।

উৎপাদনের দিক থেকে কোয়েল অন্যান্য পোল্ট্রির চেয়ে বেশি উৎপাদনশীল। ১টি মুরগীর পরিবর্তে ৮ থেকে ১০টি কোয়েল পালন করা সম্ভব। কম খরচে, অল্প জায়গায় পারিবারিক পর্যায়ে ছোট বা বড় পরিসরে অথবা অথবা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোয়েল পালন দেশে পুষ্টি ঘাটতি মিটাতে এবং জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখতে সক্ষম।

আরো পড়ুন> কোয়েল এনেছে মেহেদীর জীবনে আমেরিকান সুখ!!